মানুষ ও জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় ওজোনস্তরের অবদান অপরিসীম। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে ওজোনস্তর দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ক্ষয়িষ্ণু ওজোনস্তরের মধ্যে দিয়ে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি অতি সহজেই পৃথিবীতে প্রবেশ করে মানবস্বাস্থ্য, জীবজগৎ, উদ্ভিদজগৎ ও অণুজীবের মারাত্মক ক্ষতি করে। মাত্রাতিরিক্ত অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ওজোনস্তর ক্ষয়ের পরোক্ষ প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা ও মরুময়তাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
১৯৭৪ সালে শেরউড রোল্যান্ড ও মারিও মলিনা ন্যাচার জার্নালে তাঁদের সুবিখ্যাত গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে জানান যে, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বা সিএফসি বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তরের ক্ষতি সাধন করছে। ১৯৭৭ সালে United Nations Environment Programme (UNEP)-এর গভর্নিং কাউন্সিলে ওজোনস্তর বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রমের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। এরপর, ১৯৮৫ সালে বৃটিশ এন্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানীরা এন্টার্কটিকায় ওজোন হোলের সন্ধান পান। ফলশ্রুতিতে ওজোনস্তর রক্ষায় জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে ১৯৮৫ সালের ২২ মার্চ ভিয়েনায় একটি আন্তর্জাতিক সভায় ওজোনস্তর রক্ষায় একটি কনভেনশন গৃহীত হয় যা ‘ভিয়েনা কনভেনশন’ নামে পরিচিত। এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য ছিল ওজোনস্তর বিষয়ক গবেষণা, ওজোনস্তর মনিটরিং এবং তথ্য আদান-প্রদান। কিন্তু ভিয়েনা কনভেনশনের আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ও ওজোনস্তর রক্ষার জরুরী প্রয়োজনে ১৯৮৭ সালের ১৬
সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে ‘মন্ট্রিল প্রটোকল’ গৃহীত হয়। ঐ দিনই ৪৬টি রাষ্ট্র মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষর করে এবং বর্তমানে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এই প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে। মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হবার ফলে সিএফসি ও হ্যালনসমূহের ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে এগুলোর ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংশোধনী ও সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রটোকলটি সময়পোযোগী করে তোলা হয়। এই প্রটোকলটি প্রথমে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী ৮টি দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজনের মাধ্যমে মন্ট্রিল প্রটোকল ওজোনস্তর সুরক্ষায় যুগান্তকারী অবদান রেখে যাচ্ছে। এই প্রটোকলের আওতায় বর্তমানে প্রায় ১০০টির মতো ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার ও উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
ওজোনস্তর রক্ষায় গৃহীত মন্ট্রিল প্রটোকলের সর্বশেষ সংশোধনী কিগালি সংশোধনী (Kigali Amendment) নামে পরিচিত। ২০১৬ সালের ১৫ই অক্টোবর রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে অনুষ্ঠিত মন্ট্রিল প্রটোকলের ২৮তম পার্টি সভায় এই সংশোধনী গৃহীত হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এই সংশোধনীকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই সংশোধনীতে অধিক বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্ষমতাসম্পন্ন ১৮ ধরণের হাইড্রোফ্লোরোকার্বনের (এইচএফসি) ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রায় সকল ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যই অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রিন হাউস গ্যাস হিসাবে চিহ্নিত। মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্লোরোফ্লোরোকার্বনসহ (সিএফসি) অন্যান্য প্রধান ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়। এইচএফসি হল মানবসৃষ্ট পদার্থ যা ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের বিকল্প হিসাবে আনা হয়েছে। এই এইচএফসিগুলো সাধারণত রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমে এবং এ্যাজমা চিকিৎসায় ইনহেলারে ব্যবহৃত হয়। তবে আশার কথা হলো গ্রিন হাউস গ্যাস হিসাবে চিহ্নিত এইচএফসি-এর বিকল্প প্রযুক্তি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
মন্ট্রিল প্রটোকল ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এ প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১০ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমপরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলে নিঃসরণ এড়ানো সম্ভব হয়েছে, যা কিয়োটো প্রটোকলের প্রথম কমিটমেন্ট পিরিয়ডের প্রায় ৫ গুণ। উল্লেখ্য, কিগালি সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে এ শতাব্দির শেষে ০.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এড়ানো সম্ভব হবে, যা প্যারিস চুক্তিতে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের অধিক তাপমাত্রা না বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা বাস্তবায়নে অনেকাংশে সহায়ক হবে মর্মে ধারণা করা হয়। কিগালি সংশোধনী সফলতার সাথে কার্যকর হলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমপরিমাণ এইচএফসি নিঃসরণ হ্রাস সম্ভব হবে। বর্তমান সময়ে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী রাসায়নিক দ্রব্যসমূহের পরিবর্তে এমন সব বিকল্প বিবেচনা করা হচ্ছে যা ওজোনস্তর ক্ষয় করবে না, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হ্রাস করবে এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হবে।